গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ভব এবং বিকাশ ꘡ শর্ট প্রশ্ন ꘡ বি এ ইতিহাস

 ১. গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে? তিনি কখন সিংহাসনে বসেন?

উত্তর ঃ গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হলেন শ্রীগুপ্ত। তিনি ২৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন।

২. গুপ্ত যুগের ইতিহাস জানার জন্য কয়েকটি উপাদানের নাম উল্লেখ করো।

উত্তর ঃ গুপ্ত যুগের ইতিহাস জানার জন্য বহু সাহিত্যগত এবং প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের পরিচয় পাওয়া যায়। সাহিত্যের মধ্যে বিভিন্ন পুরাণ এবং স্মৃতিশাস্ত্র ছাড়াও দেবীচন্দ্রগুপ্তম্ নাটক, শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকম্, কালিদাসের রঘুবংশম্, অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ প্রভৃতি গ্রন্থ, ফা-হিয়েনের বিবরণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তেমনই এলাহাবাদ প্রশস্তি, নালন্দা লিপি, মথুরা লিপি এবং সমুদ্রগুপ্ত সহ অন্যান্য গুপ্ত রাজাদের অসংখ্য মুদ্রা থেকেও বহু তথ্য পাওয়া যায়। 

৩. গুপ্ত সাম্রাজ্যের সূচনার পূর্বে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল?

উত্তর ঃ গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদ্ভবের পূর্বে প্রায় দেড়শো বছর ধরে উত্তর ভারতে কোন ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য গড়ে উঠতে দেখা যায়নি। সেই সময় উত্তর ভারতে কিছু ছোট ছোট আঞ্চলিক রাজ্য গড়ে উঠতে দেখা যায়। যেমন - অযোধ্যা, বাকাটক, অহিচ্ছত্র, মালব ইত্যাদি। এছাড়া লিচ্ছবিদের মতো কিছু প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যও ছিল। এই দুর্বল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মগধকে কেন্দ্র করে গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিকাশ ঘটে। 

৪. গুপ্ত যুগে আগত দুজন চিনা পর্যটকের নাম লেখ।

উত্তর ঃ গুপ্ত যুগে আগত দুজন চিনা পর্যটকের নাম হল ই-সিং এবং ফা-হিয়েন। ই-সিং-এর বর্ণনা থেকে গুপ্তদের আদি বাসস্থান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে আমরা গুপ্ত যুগের সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারি। 

৫. গুপ্ত যুগের প্রথম সার্বভৌম রাজার নাম কি?

উত্তর ঃ গুপ্ত যুগের প্রথম সার্বভৌম শাসকের নাম প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। তিনি 'মহারাজাধিরাজ' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।

৬. প্রথম চন্দ্রগুপ্তের লিচ্ছবি বিবাহের গুরুত্ব লেখ।

উত্তর ঃ প্রথম চন্দ্রগুপ্ত বৈশালীর লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং গুরুত্ব বৃদ্ধি করেন। এর কারণ লিচ্ছবিরা তখন শক্তিশালী ছিল। এই বিবাহের ফলে লিচ্ছবি রাজ্য মগধের সাথে যুক্ত হয়েছিল এবং এর ফলে মগধ অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের মাধ্যমে তৎকালীন একটি মুদ্রা পাওয়া গেছে যার একপিঠে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত এবং ওপরপিঠে কুমারদেবীর ছবি রয়েছে। 

৭. কে, কখন গুপ্ত সম্বৎ প্রচলন করেছিলেন? এর উদ্দেশ্য কি ছিল?

উত্তর ঃ ৩১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত গুপ্ত সম্বৎ প্রচলন করেন। তিনি তাঁর সিংহাসন আরোহণকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই অব্দের প্রচলন করে। 

৮. গুপ্ত রাজাদের আদি বাসভূমি কোথায় ছিল?

উত্তর ঃ গুপ্ত রাজাদের আদি বাসভূমি কোথায় ছিল সে সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে বিতর্ক আছে। ঐতিহাসিক গয়াল, রামশরণ শর্মা প্রমুখ বলেছেন মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকা, এলাহাবাদ এবং সারনাথ অঞ্চল ছিল গুপ্তদের আদি বাসভূমি। বায়ুপুরান অনুসারে গুপ্তদের আদি বাসভূমি ছিল মগধ। ঐতিহাসিক কে পি জয়সওয়াল প্রয়াগ অঞ্চলকে গুপ্তদের আদি বাসভূমি বলে উল্লেখ করেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার সহ আরও অনেকে মালদহ এবং মুর্শিদাবাদকে গুপ্তদের আদি বাসভূমি বলে মনে করেছেন। 

৯. কাকে, কেন লিচ্ছবি দৌহিত্র বলে?

উত্তর ঃ গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তকে লিচ্ছবি দৌহিত্র বলা হয়। সমুদ্রগুপ্তের মাতা ছিলেন কুমারদেবী এবং কুমারদেবী ছিলেন লিচ্ছবি বংশের রাজকন্যা। তাই সমুদ্রগুপ্ত তাঁর মুদ্রায় নিজেকে লিচ্ছবি দৌহিত্র বলেছেন।

১০. এলাহাবাদ প্রশস্তি কে রচনা করেছেন? এই লিপির গুরুত্ব লেখ।

উত্তর ঃ এলাহাবাদ প্রশস্তি রচনা করেছেন সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ। এই লিপি থেকে সমুদ্রগুপ্তের উত্তর এবং দক্ষিণ ভারত অভিযানের কথা আমরা জানতে পারি। 

১১. কে, কাকে, কেন 'ভারতের নেপোলিয়ন' আখ্যা দিয়েছেন?

উত্তর ঃ ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তকে ভারতের নেপোলিয়ন আখ্যা দিয়েছেন। সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন যুদ্ধে সমুদ্রগুপ্তের আসাধারন সাফল্যের জন্য তাকে এই অভিধা প্রদান করেছেন ভিনসেন্ট স্মিথ।

১২. কুমারদেবী কে ছিলেন?

উত্তর ঃ কুমারদেবী ছিলেন বৈশালীর লিচ্ছবি বংশের রাজকন্যা। গুপ্ত সম্রাট প্রথম চন্দ্রগুপ্ত তাকে বিবাহ করে লিচ্ছবি রাজ্যকে নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। এর ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের শক্তি এবং পতিপত্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল।

১৩. এলাহাবাদ প্রশস্তি কোন ভাষায় লেখা। এতে কার কৃতিত্বের কথা আছে?

উত্তর ঃ এলাহাবাদ প্রশস্তি সংস্কৃত ভাষায় লেখা। এতে গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের কথা আছে।

১৪. কে, কখন 'সর্বোরাজোচ্ছেত্তা' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন?

উত্তর ঃ আর্যাবর্তের সমস্ত রাজাদের যুদ্ধে পরাজিত করে গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত এই উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। 

১৫. গ্রহণ উন্মুল্য নীতি কি?

উত্তর ঃ উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির প্রতি গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্ত যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তাকে 'গ্রহণ উন্মুল্য নীতি' বলে। এই নীতি অনুসারে সমুদ্রগুপ্ত উত্তরভারতের রাজাদের যুদ্ধে পরাজিত করে সেইসব রাজ্যগুলিকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

১৬. সমুদ্রগুপ্ত উত্তর ভারতের কোন কোন রাজাদের যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন?

উত্তর ঃ সমুদ্রগুপ্ত  উত্তর ভারতের নয়জন রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। এই রাজাদের নাম হল রুদ্রদেব, মতিল, নাগদত্ত, গণপতিনাগ, নন্দিন, বলবর্মণ, নাগবর্মণ, চন্দ্রবর্মণ প্রমুখ। 

১৭. গ্রহণমোক্ষানুগ্রহ নীতি কি?

উত্তর ঃ দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি সম্পর্কে গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্ত যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তার নাম 'গ্রহণমোক্ষানুগ্রহ নীতি'। এই নীতি অনুসারে তিনি দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিকে পরাজিত করে আনুগত্য ও করদানের প্রতিশ্রুতিতে পুনরায় সেইসব রাজাদের রাজ্যগুলি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। 

১৮. কেন সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির প্রতি 'গ্রহণমোক্ষানুগ্রহ নীতি' গ্রহণ করেছিলেন?

উত্তর ঃ সুমদ্রগুপ্ত বুঝেছিলেন যে, সুদূর উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিকে সরাসরি শাসন করা সম্ভব নয়। তাই তিনি পরাজিত রাজাদের বশ্যতা স্বীকার এবং বার্ষিক করদানের প্রতিশ্রুতিতে সন্তুষ্ট থাকার জন্য এই নীতি গ্রহণ করেছিলেন।

১৯. সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতের কোন কোন রাজাদের পরাজিত করেছিলেন?

উত্তর ঃ সুমদ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতের ১২ জন রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। এরা ছিলেন - মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজ, কৌরলের মন্তরাজ, কাঞ্চির বিষ্ণুগোপ, বেঙ্গির হস্তিবর্মণ, অবমুক্তার নীলরাজ, পলাক্কার উগ্রসেন, কুন্তলাপুরের ধনঞ্জয়, দেবরাষ্ট্রের কুবের, কোট্টুরের স্বামীদত্ত, কোশলের মহেন্দ্র, পিষ্ঠপুরমের মহেন্দ্রগিরি, এবং এরন্ডপল্লের দমন প্রমুখ।

২০. কেন সমুদ্রগুপ্ত উত্তরাপথ এবং দাক্ষিণাত্যের মধ্যবর্তী অঞ্চলটি জয় করেছিলেন?

উত্তর ঃ উত্তরাপথ এবং দাক্ষিণাত্যের মধ্যবর্তী আটবিক রাজ্যটি সমুদ্রগুপ্ত জয় করেছিলেন। এর ফলে উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতে যাওয়ার পথ সুগম হয়েছিল। 

২১. সীমান্তবর্তী কোন রাজ্যগুলি সমুদ্রগুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করেছিল?

উত্তর ঃ সীমান্তবর্তী সমতট, দাভক, কামরূপ, নেপাল এবং উত্তরের কুমায়ুন গাড়োয়াল রাজ্য সমুদ্র গুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করেছিল।

২২. কোন কোন প্রজাতন্ত্র বা গণরাজ্য সমুদ্রগুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করেছিল? 

উত্তর ঃ নয়টি প্রজাতন্ত্র বা গণরাজ্য সমুদ্রগুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করেছিল। এই রাজ্যগুলি ছিল - মালব, যৌধেয়, অর্জুনায়ণ, মদ্রক, আভীর, প্রার্জুন, কাক, সোনাকানিক এবং খারপারিক।

২৩. সিংহলের কোন রাজা সমুদ্রগুপ্তের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন? তিনি কি উদ্দেশ্যে দূত পাঠিয়েছিলেন?

উত্তর ঃ সিংহলের রাজা মেঘবর্ণ সমুদ্রগুপ্তের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন। তিনি বুদ্ধগয়ায় মঠ এবং বিশ্রামাগার তৈরি করার জন্য দূত পাঠিয়েছিলেন। সমুদ্রগুপ্ত তাকে এই কাজের জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন।

২৪. সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যসীমা উল্লেখ করো।

উত্তর ঃ সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য ছিল - কাশ্মীর, পশ্চিম পাঞ্জাব, পশ্চিম রাজপুতানা, সিন্ধু ও গুজরাট বাদে সমগ্র উত্তর ভারত এবগ্ন দক্ষিণে উড়িষ্যার উপকূল ধরে তামিলনাড়ুর চিঙ্গোলকোট জেলা পর্যন্ত। 

২৫. কোন গুপ্ত সম্রাট কখন অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন? কোন বিবরণ থেকে এই কথা জানা যায়?

উত্তর ঃ গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে একথা জানা যায়। 

২৬. ভারতের বাইরে কোন কোন প্রতিবেশী অঞ্চল সমুদ্রগুপ্তের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন?

উত্তর ঃ সিংহলের রাজা মেঘবর্ণ, পশ্চিম পাঞ্জাবের রাজা দৈবপুত্র শাহী শাহানুশাহী, শক মুরন্ড এবং ভারত মহাসাগরের অন্যান্য দ্বীপগুলি সমুদ্রগুপ্তের সাথে মিত্রতাবদ্ধ হয়েছিল। 

২৭. সমুদ্রগুপ্তের ধর্মমত সম্পর্কে লেখ।

উত্তর ঃ সমুদ্রগুপ্ত ব্রাহ্মণ্যধর্মের সমর্থক ছিলেন। তার বিভিন্ন মুদ্রায় বহু হিন্দু দেবদেবীর নাম ও ছবি পাওয়া যায়। তবে তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষত বৌদ্ধধর্মের প্রতি তিনি সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। বৌদ্ধপণ্ডিত বসুবন্ধু তার রাজসভায় উচ্চ আসন লাভ করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সিংহলের রাজা মেঘবর্ণকে তিনি বোধগয়ায় বৌদ্ধমঠ নির্মাণের জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। 

২৮. সমুদ্রগুপ্ত কি বহুগুণমণ্ডিত শাসক ছিলেন?

উত্তর ঃ এলাহাবাদ প্রশস্তি, মুদ্রা এবং সাহিত্য থেকে সমুদ্রগুপ্তের বহুমুখী প্রতিভার কথা জানা যায়। এইসব মুদ্রায় সমুদ্রগুপ্তের ব্র্যাঘ্রহন্তা, ধনুর্ধর এবং বীণাবাদনরত ছবি পাওয়া গেছে। এগুলি থেকে বলা যায় তিনি একদিকে যেমন শক্তিশালী যোদ্ধা তেমনই সংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। কাব্যচর্চার জন্য তিনি 'কবিরাজ' উপাধি লাভ করেন। সুতরাং সমুদ্রগুপ্তকে বহুগুণমণ্ডিত শাসক বলা হয়। 

Post a Comment

0 Comments